কুন্তল চৌধুরী | রবিবার, ১১ অক্টোবর ২০২০
আমার এক আত্মীয় তার সদ্যজাত ফুটফুটে সন্তানের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে লিখলেন – সকলের কাছে আমার এই সন্তানের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনীয় । আমি কমেন্টে লিখলাম – কট্টর মৌলবাদী হয়ে গড়ে ওঠো , অমানুষের মতো অমানুষ হও , লুটেরা ধর্ষক হয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করো । বলাবাহুল্য সেই আত্মীয় আমাকে ব্লক করলেন । সত্যযুগে মানুষ রেগে গেলে অভিশাপ দিত । এখন আর মানুষ অভিশাপ দেয় না । কারণ যতই অভিশাপ দেয় ততই তার উন্নতি তর তর করে হতেই থাকে । তাই কলিযুগে মানুষ রেগে গেলে ব্লক করে দেয় তার ফেসবুক আইডি থেকে ।
যথারীতি আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এই নিয়ে তীব্র শোরগোল পড়ে গেল । সবাই একে একে তীব্র ভৎর্সনা করতে লাগলেন কখনো ফেসবুকে কখনো ফেস টু ফেস । এক সন্ধ্যায় পাড়ার ক্লাব থেকে চিঠি এলো আগামী রবিবার সন্ধ্যে সাতটায় আমায় হাজির থাকতে হবে ক্লাবে । কারণ অসামাজিক মন্তব্যে আমি সমাজকে কলুষিত করতে চেয়েছি । হেন কাজের জন্য সামাজিক বিচারের আয়োজন করা না হলে সমাজ ক্রমশই অন্ধকারময় হয়ে পড়বে । আমায় নিরুত্তাপ দেখে বাড়ির লোকজন উত্তপ্ত হয়ে উঠল । বৌ মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কেন এসব লিখতে গেলে , তোমার কী কাউকে ভালো কিছু লিখতে গায়ে ফস্কা পড়ে ? আর এভাবে কী কেউ কাউকে আশীর্বাদ করে ? তোমার সন্তানের বেলায় কেউ অমন লিখলে তুমি কী করতে ? আমি কথা বলি না । কারণ কথায় কথা বাড়ে । আমার আওয়াজ না পাওয়ায় তার মেজাজ সপ্তমে উঠতে থাকে । দেখো কেমন ঘাপটি মেরে রয়েছে । মনে হচ্ছে কিস্যুটি জানেনা । এখন দেখব তোমার পান্ডিত্য তোমাকে কেমন করে বাঁচায় ।
আজ রবিবার । সারা বাড়ি থমথমে । কেউ কোনো কথা বলছে না আমার সাথে । আমি আমার লেখাতেই ডুবে রইলাম । শুধু আমার মেয়েটা কাছে এসে বলল আচ্ছা বাবা আজ নাকি তোর বিচার হবে ? আমি বললাম হ্যাঁ গো মা আজ আমার বিচার হবে । সে আবার বলল তোর ভয় করছে না ? আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম একটুও না । আমি তো অন্যায় কিছু করিনি যে ভয় পাব । তাহলে ওরা তোর বিচার করবে বলছে কেন ? আমি বললাম মাগো ওদের কাছে মনে হয়েছে আমি অন্যায় করেছি । আজ কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তারই বিচার হবে । সে সাথে সাথে আমার গালে চুমু দিয়ে বলল আমিও যাব তোর সাথে । আমি বললাম তাহলে তো মা আমার আর কোনো ভাবনাই নাই । তুমি সাথে থাকলে কারোরই সাহস নেই আমাকে বকা দেয় ।
পোনে সাতটায় চলে গেলাম ক্লাবে । এটা আমার এক চিরাচরিত অভ্যেস সময়ের আগে পৌঁছে যাওয়া । কেয়ারটেকার বলল এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে ? সকলের আসতে এখনো অনেক দেরি । এতোক্ষণ এখানে একা না থেকে বাসায় চলে যান । সবাই এলে পরে আপনাকে ফোন করে জানাব । আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম এসেছি যখন , তখন একেবারে মিটিং শেষ করেই যাব । বরং দুটো চেয়ার দাও । বাপ বেটিতে মিলে মনের সুখে একটু কথা বলি ।
সোয়া সাতটার দিকে ধীরে ধীরে সবাই আসা শুরু করল । ক্লাবঘরের হলরুম ভরে যেতে লাগল একটু একটু করে । আমার অভিযোগকারী আত্মীয়েরা যারা আমাকে শত্রু মনে করেন তারাও জড়ো হলেন । আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরেই বসলেন । যেন ছোঁয়া না লাগে । ক্লাবের সেক্রেটারি প্রথম মুখ খুললেন । আমাকে বললেন আপনার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ । আপনি তার সন্তান কে আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ দিয়েছেন । আমি সেক্রেটারিকে বললাম আমি যে অভিশাপ দিয়েছি তার কোনো প্রমাণ আপনার কাছে আছে ? উনি বললেন না তা নেই । আপনার সেই কমেন্টস তো উনি ডিলিট করে দিয়েছেন পোস্টের সৌন্দর্য্যতা বজায় রাখতে । আমি বললাম প্রমাণ যখন নেই আমি অস্বীকার করতেই পারি । কিন্তু তা আমি করব না । কারণ আমার মেয়ে দেখুক তার বাবা সত্য স্বীকারে ভয় পায় না । তবে আমি তাকে অভিশাপ দেইনি বরং আশীর্বাদই করেছি । আমার আশীর্বাদ আপনাদের সকলের কাছে অভিশাপ মনে হতে পারে ।
আমার সেই আত্মীয় ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন দু’দিনের যোগী ভাতকে বলে অন্ন । হালে একটু লেখালেখি শুরু করেছে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করছে । তাও যদি পেপার টেপারে ছাপা হতো তাহলেও নয় বুঝতাম । লেখে তো ঐ ফেসবুকে । আর লেখার কী ছিরি ? পাতেই দেয়া যায় না ছিঃ । তাতেই বাবুর দেমাক কত ? আমি হা হা করে হেসে ফেললাম তার কথায় । আমার হাসিতে সবাই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । সেক্রেটারি আমার সেই আত্মীয়কে বললেন ব্যক্তিগত কুৎসা শোনার জন্য আমরা এখানে বসিনি । আমাকে বললেন আপনার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আপনি তাহলে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন ? আমি বললাম অভিযোগ অস্বীকার করছি কিন্তু লেখাটা সত্যি । আবারো বলছি সেটি ছিল আশীর্বাদ , অভিশাপ নয় । উনি বুঝতে ভুল করেছেন । সেক্রেটারি বললেন এটা কী ধরনের আশীর্বাদ বুঝিয়ে বলবেন কি ? এমন অভিনব আশীর্বাদ জীবনে প্রথম শুনলাম । এরপর থেকে না হয় আপনার আশীর্বাদকেই আমরা অনুসরণ করব ।
আমি বললাম আমার বক্তব্যটা দীর্ঘ হবে যদি আপনারা তার ব্যখ্যা চান । অবশ্যি তার প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না । কমন্টসে লিখেছিলাম কট্টর মৌলবাদী হও , লুটেরা হও , ধর্ষক হয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করো । আচ্ছা আমরা তো প্রতিটা শিশুকেই আশীর্বাদ করে বলি মানুষের মতো মানুষ হও । কিন্তু আমরা কি সেই ভাবে শিশুকে বড়ো করে তুলি ? নিশ্চয়ই না । যদি করতাম তাহলে তাকে স্বার্থপর হতে শেখাতাম না । কখনো তাকে বলতাম না স্কুলে তোমার টিফিন অন্য কারোর সাথে শেয়ার করবে না । কখনো বলতাম না রাস্তায় কোনো ঝুটঝামেলা দেখলে তাতে নিজেকে জড়াবে না । নিজে বাঁচলে বাপের নাম । বড়ো হতে হলে স্বার্থপর হতে হবে । বাড়ি এবং স্কুলের টিচার ম্যাম ছাড়া কোনো বন্ধুত্ব পাতাবে না । কিন্তু দেখেন সবাই আশীর্বাদ করেছিল সে যেন মানুষ হয় । অথচ তাকে তৈরি করছি অমানুষের আদলে । মানুষের থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছি সেই শৈশব থেকেই ।
প্রতিদিন একটা শিশু সন্তান বড়ো হয়ে ওঠে ঘরে বাইরে রাস্তাঘাটের আনাচে কানাচে মাইকে মোবাইলে ওয়াজ মাহফিলের নামে মেয়েদের নিয়ে নানা বাজে মন্তব্য শুনতে শুনতে । মেয়েদের কখনো খোলা মিষ্টি কখনো তেতুল বলে নানা খাদ্যের সাথে তুলনা করা হয় । মেয়েরা পুরুষের ভোগের সামগ্রী । তাদের জন্ম হয়েছে শুধু পুরুষকে আনন্দ দেবার জন্য ।
আমরা কেউকি তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো প্রতিবাদ করেছি না রুখে দাঁড়িয়েছি ? বরং তা না করে আমাদের মেয়েদেরকেই আপাদমস্তক ঢেকে রেখে ঐসব ফতোয়াবাজদেরকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়ে গেছি । যে মনু সংহিতাকে হিন্দুরা তাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে একমাত্র মানদন্ড মনে করেন সেই মনু সংহিতায় মেয়েদেরকে পদে পদে যেভাবে অপদস্থ করা হয়েছে তা পড়লে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় ।
সেখানে ঋষি মনু বলছেন – শাস্ত্র মতে স্ত্রী জাতি হলো মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ ,৯/১৮ । মূর্খ হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধে বশীভুত পুরুষদের বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয় , ২/২১৪ ।আরও যদি প্রমাণ চান সবিস্তারে সেই প্রমাণ দিতে পারব । অথচ তারাই আবার বলে মায়ের পায়ের নীচে স্বর্গ ।
এ কেমন দ্বিচারিতা ? তো সেই শিশু বড়ো হলে ধর্ষক হবে না তো কী হবে বলতে পারেন ? আমরা কি এই শিশু সন্তানকে একজন ধর্ষক করে গড়ে তুলছি না ? এখানে উপস্থিত এক সদস্যকে একদিন বলেছিলাম তোমার ছেলের জন্য তো সন্ধ্যের পরে অলিগলিতে ঢোকাই দায় । একটুতো শাসন করতে পারো । তার বেলাল্লাপনায় তো আমাদেরই মানসম্মান যায় । শুনে সে হাসতে হাসতে বলেছিল আরে এই বয়সে একটু আধটু সবাই শান দেয় । আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম তার মন্তব্যে । আমার এই মেয়েটাকে কোথায় রেখে যাচ্ছি বলতে পারেন ?
প্রতিদিন একটা শিশুকে শোনানো হয় তার ধর্মই শ্রেষ্ঠ । বাকি সব ধর্মালম্বীরা নিকৃষ্ট । তারা কখনো স্বর্গে বা বেহেস্তে যেতে পারবে না । তাদের হত্যা করা তাদের উপাসনালয় ভেঙে ফেলা ধর্মের কাজ । আমরা কি কখনো তার প্রতিবাদ করে বলেছি মানবতাই একটা মানুষের প্রধান ধর্ম ? প্রতিবাদ করিনা কারণ আমিও সেই মতে বিশ্বাসী এবং সেই কারণেই আমার শিশুকে আমি মানুষ না গড়ে গড়ছি কট্টর মৌলবাদী করে । তার এই শিশু মনে ধর্মের বিষ ছড়িয়ে দিয়ে তাকে কি অমানুষ করে গড়ে তুলছি না ? এই যে এখন একদিকে নারায়ে তকবির অপরদিকে জয় শ্রী রাম বলে একে অপরের দিকে খোলা তরবারি উঁচিয়ে রণ হুংকারে ছুটে যাচ্ছে তার জন্য কি আমরা প্রত্যেকে দায়ী নই ? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন কেউ ?
আধুনিকতার নামে সন্তানের সিগারেটের প্যাকেট বাবা হয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছি । মদের টাকা নেশার টাকা প্রতিদিন যুগিয়ে যাচ্ছি । ফেস্টিবেলে ছেলে মেয়ে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে বসে এক সাথে মদ গিলছি । এটাই কি আমাদের কৃষ্টি আমাদের সভ্যতা ? আমার বাসার সামনের দোকানদার যে সব ছেলে মেয়েদের জন্মাতে দেখেছে আজ তাদেরকেই সে সিগারেট বিক্রি করছে অবলীলায় ।
আজ তারাই প্রকাশ্যে আমার আপনাদের সামনে ধোঁয়া উড়িয়ে বেড়ায় । এই নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য কি আমরা দায়ী নই ? প্রতিনিয়ত আমরাই নিজের ভাষা নিজের পরিবার নিজের সমাজ জাতি নিজের শিক্ষা দীক্ষা কর্ম এবং ধর্মের সাথে প্রতারণা করে ধর্ষণ করে চলেছি স্বজ্ঞানে বীরদর্পে । লুট করছি নির্লজ্জভাবে ।
একজন শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর আগে সেই ছাত্রের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস দেখেন । তাদের দামি গাড়ি আছে কি না , মাসিক উপার্জন কত । এই যদি হয় ছাত্রকে জ্ঞান দানের শিক্ষকের মানদন্ড তাহলে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত কোথায় ? একবারও কি ভেবে দেখেছি এর পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে ?
যদি আশীর্বাদ করলে অভিশাপের মতোই ফল পাওয়া যায় তাহলে সেই আশীর্বাদ না করে অভিশাপ দেয়াটাই উত্তম । তাতে যদি অন্তত একটা শিশু প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে । এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর জন্য মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে চিৎকার করে বলতে পারে আলো দাও ।
সারা হলঘর পিনপতন নীরবতা । সবাই মাথা নীচু করে বসে আছেন । নীরবতা ভেঙে বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ সভাপতি এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন আমাদের দেয়া শিক্ষা যে এখনো শেষ হয়ে যায়নি আজ তুমিই তা প্রমাণ করে দিলে বাবা । তোমার এই বক্তব্যে যদি এক জনেরও হুঁশ ফেরে তাহলে আমাদের সকলের জন্যই মঙ্গল । আজ বহুদিন পর বুকের ওপরে বসা থাকা অভিশপ্ত একটা পাথর কিছুটা হলেও আলগা হলো ।
Posted ২:১৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১১ অক্টোবর ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি