| রবিবার, ১৭ মে ২০২০
আব্দুল্লাহ আল মাহাদী :
বিশ্বব্যাপী এই অনাকাঙ্খিত করোনা মহামারিতে গত প্রায় দু’মাস ধরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হতে বেশি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে স্কুল শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে যে, বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ এ অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে লেখাপড়া বিমুখ হওয়ার পাশাপাশি ভিন্ন কোন বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে দিনদিন। কেউ হয়তো ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে, কেউ গেমের জগতে ঢুকে ঘুম-খাওয়া সব কিছুতে অনিয়ম শুরু করেছে। একটানা ঘরে থাকতে থাকতে অভিভাবকদেরকেও মানতে চাচ্ছে না, কথার অবাধ্য হয়ে পড়ছে।তবে এসবের জন্য তাদের অপরিণত বয়সই দায়ী হতে পারে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার জন্য শনিবার দৈনিক নাগরিক ভাবনা ও প্রথম দৃষ্টি মিডিয়া সহযোগিতায় অনলাইন ভিত্তিক লাইব্রেরি- স্টাডি হেল্পস একটি লাইভ টকশো’তে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করি। এতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একজন অভিভাবক এবং একজন শিক্ষককে। অতিথিদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার চুম্বকীয় অংশ এখানে তুলে ধরছি।
অনুষ্ঠানে অভিভাবকের ভুমিকায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবি অ্যাড. আবু বকর সিদ্দিক। তিনি দাবী করেন যে, যেহেতু স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের বয়স তুলনামূলক কম তাই সাধারণত তারা নিজের থেকে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেও কম, সুযোগ পেলেই তারা অন্য মনস্ক হয়ে যায়, ফাঁকি দেয়ারও একটি প্রবণতা কাজ করে তাদের মনে। এমতাবস্থায় অনির্দিষ্টকালের এই স্কুল বন্ধের ফাঁদে পড়ে তারা অনেকেই এখন পুরোপুরি বই-খাতা বিমুখ হয়ে মোবাইলসহ নানা রকম ডিভাইসে আসক্ত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে তারা ইন্টারনেটে ডুবে যাচ্ছে পুরোপুরি, যেখান থেকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় তাদেরকে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করানো বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে অভিভাবকদের জন্য।
তবে অন্য অতিথি বলছেন ভিন্ন কথা, তার মতে এই ইন্টারনেটই পারে শিক্ষা ব্যবস্থার চলমান সংকট কাটিয়ে তুলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়াতে। আমন্ত্রিত এই অতিথি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আব্দুল্লাহ আল মীযান আরো বলেন, যেহেতু চলমান এই মহামারির জন্য আমরা কেউ প্রস্তু না থাকলেও এখন দিনদিন প্রস্তুত হতে হচ্ছে, সেহেতু এই সংকট কাটিয়ে তুলতে ইন্টারনেটই আমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারে। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে লেখাপড়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও রুটিন করে অনলাইনে তাদের পাঠ দান কার্যক্রম চালাতে পারে। অন্যথায় তিনিও মনে করেন যে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এক সময় বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে।
তিনি বলেন পৃথিবীর অনেক দেশই এই পরিস্থিতেশিক্ষা কার্যক্রম সহ অনেক কাজই এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ হয়তো আরো দীর্ঘ থাকতে পারে এদেশে কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষা লাভ হতে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে তাহলে তাদের জীবন অনেক পিছিয়ে যাবে, যা হবে প্রত্যেকের ব্যক্তি জীবনে একটি অপূরণীয় ক্ষতি, দেশও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মূখীন হবে। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে ড. মীযান ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের বিভিন্ন পদ্ধতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করনে।
পক্ষান্তরে অ্যাড. আবু বকর তার সাথে অনেকটা দ্বিমত পোষণ করে বলেন যে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই সময়ে অনলাইন ভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন করে আরেকটি বৈষম্য তৈরি করবে। এতে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন কøাসে অংশ গ্রহণ করতে পারলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা পারবে না।
এমনিতেই অনেক আগে থেকে এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী-গরীবের একটা বৈষম্য রয়েছে। গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষা লাভে ব্যর্থ হচ্ছে, তদুপরি সরকার চেষ্টা করছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সবাইকে নূন্যতম শিক্ষার আওতায় এনে শিক্ষার হার বাড়াতে। কিন্তু এখন যদি অনলাইনে পাঠদান পদ্ধতি চালু করা হয় তাহলে অনেক শিক্ষার্থীই রয়েছে যারা ডিভাইস ইত্যাদি জোগাড় করতে না পারায় শিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়বে। এতে এক দল শিক্ষার্থী এগিয়ে যাবে আরেকদল পিছিয়ে যাবে, এটা বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করবে।
তার কথার জবাবে ড. মীযান বলেন, এই সরকার আমলের শুরু হতেই ডিজিটাল শিক্ষার উন্নয়নে ধারাবাহিক কাজ চলছে। সরকারিভাবেই সকলকে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বা অনেকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব অনুভব করেনি, কিন্তু এখন যেহেতু আমরা পরিস্থিতির শিকার সেহেতু এটা খুব দ্রæত কার্যকর করা যাবে।
এক্ষেত্রে বৈষম্যের কোন প্রশ্নই যৌক্তিক নয় বলে তিনি মনে করেন, তিনি বলেন পৃথিবীর অন্য সব উন্নত দেশের মত আমাদের দেশও আধুনিকায়নে এগিয়ে যাবে, এতে বৈষম্যের প্রশ্ন তুলে নিজেদেরকে পিছিয়ে রাখা অনুচিত হবে, বরং আমরা সরকারের কাছে প্রতিনিয়ত এই দাবী জানাতে পারি যে, যেন বৈষম্য রোধ করে সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে এই আধুনিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারি।
তবে এখন যেহেতু একটি জরুরি মূহুর্ত চলছে সেহেতু শুধু সরকারি পদক্ষেপের ওপর নির্ভও না করে প্রতিটি সামর্থবান শিক্ষার্থী এবং অভিভাবককেও পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। তিনি এক্ষেত্রে পরামর্শ দেন যে, যদি এরকম অনলাইন ক্লাস আরম্ভ হয় তাহলে সামর্থবান শিক্ষার্থীরা তার প্রতিবেশি বন্ধুর জন্য অন্তত নির্দিষ্ট সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার উন্মুক্ত কওে দিয়ে হলেও সহযোগিতা করতে পারে।
অ্যাড. আবু বকর বলেন, অনলাইন ক্লাস তো পরের কথা, আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগুচ্ছে, তারা জানেই না যে এই ক্লাস করে কী হবে, তাদের পরীক্ষা হবে কিনা, উপরের ক্লাসে উঠতে পারবে কিনা, এসব ভেবেই তো তারা হতাশায় ভুগছে। এমতাবস্থায় কেউ কী এইসব ক্লাসের প্রতি আগ্রহী হবে? তিনি বলেন, আগে বেঁচে থাকা ও ভালো থাকা জরুরি, সেহেতু শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নয়; বরং যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লেখাপড়ার পাশাপাশি বিনোদন বা কুইজ ইত্যাদি প্রতিযোগিতার আয়োজনও করে তাহলে শিক্ষার্থীরা
মানসিকভাবে ভালো থাকবে। তিনি বারবার দাবী করেন যে, এসব বিষয়ে খুব শিঘ্রী সরকারি একটি নীতিমালা আসা দরকার, সরকার শুধু স্কুল বন্ধ ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে পারে না, বরং একটা কার্যকর নীতিমালা এনে শিক্ষার্থীদের বর্তমান সংকট কাটিয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে। অন্যথায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশায় এরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
জবাবে ড. মীযান সহমত পোষণ করে বলেন যে, তিনিও তার অধীনস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য এই ছুটিকালীন অনলাইন পাঠদানের পাশাপাশি বিভিন্ন বিনোদন ও শিক্ষামূলক কাজ দিচ্ছেন। তিনি মনে করেন যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা এই করোণাকালেও একটি ভালো মূহুর্ত অতিবাহিত করতে পারবে।
অ্যাড. আবু বকর উপস্থিত ড. মীযানের মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান যে, শিক্ষকরাই যেহেতু শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় অভিভাবক তাই তারা যেন নিয়মিত যেকোন উপায়ে এসব ছেলেমেয়েদেরকে একটা দিক নির্দেশনার মধ্যে রাখেন, কারণ তারা শিক্ষকের নির্দেশ যেভাবে মানে মা-বাবার নির্দেশ সেভাবে মানতে চায় না। এমতাবস্থায় তাদেরকে ইচ্ছা-স্বাধীন মত দীর্ঘদিন ছেড়ে দিলে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
ড. মীযান উত্তরে বলেন, যে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দ্বারা যদিও শিক্ষার্থীদেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয়া সম্ভব নয় তবে তারা ফোনে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেও সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছেন। তবে তিনি এই অভিভাবকের কাছে পাল্টা অনুরোধ জানান যে, অভিভাবকদেরও উচিত তাদের তাদেও ক্লাস টিচারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা, শিক্ষকের পরামর্শ নেয়া এবং শিক্ষার্থীর সাথে একটি যোগাযোগ করিয়ে দেয়া।
আলোচনার এক পর্যায়ে কথা ওঠে প্রাইভেট স্কুলগুলোর মাসিক বেতন নিয়ে। যেহেতু এখন স্কুলগুলো সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ রাখা হয়েছে তাই তারা গত দুই মাস ধওে কোন টিউশন ফি নিতে পারছেন না। যদিও সরকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে তবে তা কবে নাগাদ কার্যকর হবে তার নিশ্চয়তা নাই এবং তা যথেষ্ট হবে বলেও মনে হয়না। এমতাবস্থায় স্কুলগুলোও বিপাকে পড়েছে।
অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদেরকে বেতন দিতে পারছে না, ঘর ভাড়াও বাকি পড়ে যাচ্ছে। এখন প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষকদেরকে বেতনই দিতে পারছেনা সেখানে সেই শিক্ষকরাও তাদের পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এজন্যও শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে ড. মীযান মনে করেন, তিনি বলেন সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো নয়, অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যে নিয়মিত টিউশন ফি নেয়ার পরও টানাপোড়েনে থাকে।
তার এই আলোচনার প্রেক্ষিত্রে অ্যাড. আবু বকর সহমর্মিতা প্রকাশ কওে বলেন যে, হ্যা, যে সব অভিভাবক সামর্থবান রয়েছেন তাদেও উচিত এই দু:সময়ে টিউশন ফি বাকি না রেখে পরিশোধ করে দেয়া, যাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঠিক মত চলতে পারেন।
তবে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই অনির্দিষ্টকালের স্কুল বন্ধের মধ্যে শিক্ষার্থীরা পুরো বেতন কেন দিবে, যদি শিক্ষার্থীদের একটি শিক্ষা বর্ষ বাদই পড়ে যায় বা অনিশ্চিত হয়ে যায় তবে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির দায়ভার শিক্ষার্থীরা কেন নেবে এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে বেতন নেয়ার জন্য স্কুলের অফিস খোলা রেখে অভিভাবকদেরকে বেতন নিয়ে স্কুলে যেতে বলা কতটা যৌক্তিক হবে? রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকরা ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে ক্ষোভও প্রকাশ করেছে যে, স্কুল হতে তাদেরকে টিউশন ফি পরিশোধের জন্য নানা কৌশলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ তুলেছে যে শুধু মাত্র টিউশন ফি আদায়ের জন্যই তাদের ভার্সিটি নামমাত্র অনলাইন ক্লাস চালু রেখেছে। নাগরিক ভাবনার পরবর্তী অনুসন্ধানে থাকবে এসব প্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর, উঠে আসবে সেগুলোর নাম ও অভিযোগকারীদের বক্তব্য।
Posted ২:৫০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৭ মে ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি