| মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৯
ফিরোজ আল সাবাহ্
এ বছর অক্টোবর চলে যাচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না, আকাশ মেঘলা, উত্তরের দিগন্ত ঘোলাটে , মন উদাসীন, চঞ্চল। দেখে মনে হয় উত্তরের আকাশ থেকে এত্ত বড় জিনিস টা মনে হয় কেও মুছে দিয়েছে। অক্টোবর এর একেবারে শেষে দেখা দিলো পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ টি। মন নেচে উঠলো।পঞ্চগড়ের সমতল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা একধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর এই সময়ে মন আনচান করে। কখন দেখা দেবে সুন্দরীতম।
হুট করে বরাবরের মত লেমন ভাই জানালেন কাঞ্চনজঙ্ঘা স্বমহিমায় উজ্জল, তখন আমি রামসাগরের রেস্ট হাউজে। তড়িঘড়ি কাজ শেষ করে ফিরলাম বাসায়। বাসায় ফিরেই ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে তেতুলিয়া। দুদিন থাকলাম কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। তারপর আরেকটা ট্রিপ তাও সফল হলো না।
হুট করে আবার তুষারের ফোন ভোর এ৷ আবার ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ভিউ। দুপুরের পর আবার রওনা দিলাম মেহেদী, তুষার, শরীফ সহ। তেতুলিয়ায় অপেক্ষা করছে লেমন ভাই৷
বাইকযোগে যখন পৌছালাম গন্তব্যে তখন সুর্য তার দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে পাততাড়ি গোটাতে ব্যস্ত। কিন্তু ভাব খানা এমন যাওয়ার আগে আকাশকে রংয়ে ভরিয়ে দেবে। আমরা সবাই খোলা ক্ষেতে বসে দেখছিলাম আকাশ আর তার পটে রং এর খেলা!!
এত অদ্ভুত সুন্দর আকাশ খুব কম দেখেছি। রং এর মেলা বসেছে যেন, মুহুর্তে মুহুর্তে আকাশে দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছিল। আমিও ছবি তুলে যাচ্ছিলাম সমান এ। পাহাড় ও লুকোচুরি খেলছিল৷ একসময় পাহাড়ে মেঘে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বুঝতে পারলাম সন্ধ্যা নেমে গেছে, ক্যামেরা ফোকাস করতে যুদ্ধ করছে৷ ওদিকে শরীফ গলা ছেড়ে গান ধরেছে।
ফেরার পথে বেরং সেতুতে ব্রেক দিলাম সবাই। আকাশ চুয়ে পড়ছে জোসনা। আবার শরীফ সুমিস্ট গলায় গান ধরলো। আকাশে স্টার ম্যাপ দিয়ে তারা দেখছিলাম হটাৎ মনে হলো আকাশের তেলেসমাতি দেখানো শেষ হয় নি। আকাশে আরেকটি রেয়ার ফেনোমেনন। চাদের চারিপাশে একটা গোল বৃত্ত। যেটাকে ২২° হ্যালো বলা হয়। অদ্ভুত সুন্দর! অদ্ভুত!! আকাশে তারার মেলা আর চাঁদ কে ঘিরে আছে আইস ক্রিস্টাল এর বৃত্ত। মেঘ ভেসে ভেসে যাচ্ছে আকাশ জুড়ে। আবার ছবি তুলতে লেগে গেলাম। ছবি পরে শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ
দীর্ঘ সময় সেখানে থেকে মনে হলো এবার রুমে ফেরার দরকার রাত অনেক গভীর হয়েছে। বেশ শীত অনুভব হচ্ছিল। কাল আবার ভোর চারটায় উঠে বের হতে হবে কনকনে ঠান্ডায়। আমরা রুমে ফিরলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন জানি না।
ঘুম ভাংলো এলার্মে। দুই তিন টা ফোন সমানে বেজে যাচ্ছে। রীতিমতো ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে বের হলাম চারজন দুইটা বাইক নিয়ে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস চিরে পৌছালাম গন্তব্যে। তখন পূর্বাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। আকাশে বেশ মেঘ এর আনাগোনা। মনে সংশয় পাহাড় দেখা যাবে কি না। মনের সব সংশয় দুর করে দেখা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভোরের প্রথম আলোয় জ্বলজ্বল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ সব গুলো চুড়ো। হেমন্তের ভোরে বিস্তীর্ণ সোনালী ধান ক্ষেতের উপর সিনিওলচু, পান্ডিম, নার্সিং সহ বাকি সব চুড়ো তখন সোনালী আভায় ভরে গেছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এমন সমতল থেকে পাহাড় দেখার অনুভুতি অন্যরকম। সারা সকাল পাহাড় দেখে কাটালাম, আবার সাদা মেঘের দল ঢেকে দিল পাহাড়। আবার পাহাড়ে মেঘে লুকোচুরি। আমরা এদিক সেদিক ঘুরে ক্লান্ত দুপুরে খেয়ে দিলাম ঘুম।
আবার শেষ বিকেলে বের হব পাহাড় দেখতে। বিকেলে আবার বের হলাম, কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ না। হুট করে আকাশ আবার রক্তিম হয়ে গেল শেষ বিকেলে। রং এর উৎসব শুরু হলো পশ্চিমাকাশ জুড়ে। সে উৎসব এ যোগ দিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও হাজির৷ সোনায় সোহাগা যাকে বলে। অদ্ভুত বিচিত্র রঙে সেজেছে পাহাড়।
সোনালী ধানক্ষেত আরো সোনালী হয়ে গেছে। রঙের বৈচিত্র্যে চোখ ধাধানো অবস্থা। ছবি তুলছিলাম এদিক সেদিক দৌড়ে, হুট করে দেখি পাহাড়, আকাশ সব গোলাপী হয়ে গেছে। সে এক অন্যরকম অতিপ্রাকৃত দৃশ্য। এত গুলো পাহাড় দেখা যায় ভাবিনি, পশ্চিম থেকে পুর্ব পাহাড় আর পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ সহ পশ্চিমবঙ্গের সব পাহাড় দৃশ্যমান।সাথে ভুটানের কিছু পাহাড়। কতটুকু ক্যামেরায় ধরতে পেরেছি জানিনা। তবে চোখে যা দেখেছি তা ভাষায় বা ছবিতে ব্যাখ্যা করা যাবেনা৷ সুখ বেশিক্ষন সইলো না। আধার নেমে এলো। কিন্তু আমাদের মন আলোয়, রঙে, পাহাড় দেখার আনন্দে ভরপুর। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান সফল!!
ওয়েদার ফোরকাস্ট বলছে এ মাস বেশ ভালো দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আজ ও বেশ দেখা গেছে। যারা আসতে চান কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চলে আসুন দেরী না করে৷ছবিটি গতকাল শেষ বিকেলে রওশনপুর এর ভুতিপুকুর গ্রাম থেকে তোলা। ভুতিপুকুর ছাড়াও তেতুলিয়ার যে কোন ফাকা যায়গা থেকেই দেখা যায় পাহাড়।
ঢাকার থেকে ট্রেনে বা কোচে আসতে পারেন পঞ্চগড়, সেখান থেকে তেতুলিয়া । ট্রেন ছাড়ে সকালে ও রাতে, বাস ও তাই। তেতুলিয়ায় থাকার জন্য হোটেল আছে সীমান্তের পাড়, কাজী ব্রাদার্স আরো আছে ডাকবাংলো। আর ডাক বাংলোয় থাকতে হলে উপজেলা / জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে আসা ভালো।
হোটেল ভাড়া ডাবল ৮০০ সিংগেল ৫০০। হোটেল ভেদে কম বেশি হতে পারে। খাওয়ার জন্য বাংলা হোটেল আছে, বেশ ভালো মানের খাবার পরিবেশন করে তারা। রাতে হোটেল এ থেকে প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেতে হলে ভোরে সুর্য উঠার আগেই বের হতে হবে। বের হয়ে মহানন্দার পাড়ে বসতে পারেন সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্দান্ত ভিউ পাওয়া যায়। অথবা আরো ভোর বের হয়ে যেতে পারেন ডাহুক সেতু বা রওশনপুরের ফাকা মাঠে তাতে পাহাড় দেখা বেশ জমবে। ভ্রমনে পরিবেশের প্রতি খেয়াল রাখবেন। অনাকাংখিত জায়গায় ময়লা ফেলা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ রইলো। আর কোন তথ্য দরকার হলে বা ভ্রমনে এসে যেকোন সমস্যা ফেস হলে জানাবেন। স্বাগতম হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় এ৷
Posted ৫:৪৯ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৯
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি