নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০
তীব্র কনকনে শীতের সকালে চা পাতা তুলছে শ্রমিকরা
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এখন হাঁড়কাপা শীত। রেকর্ড পরিমাণ নি¤œতাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে প্রতিদিন। বরফে শীত অনুভূত হলেও থেমে নেই কনকনে শীতের মধ্যেও সীমান্তের চা শ্রমিকদেও দৈনন্দিন কাজ। বাগানের পাতায় পাতায় শিশির ভেজা বরফ ঝরলেও সে বরফও হার মানছে শ্রমিকদের কাছেই। সূর্যোদয়ের আগেই ভোরেই দলবেঁধে বাগানে চা পাতা উত্তোলনের কাজে লেগে যায় শ্রমিকরা। অনেক সময় রাতেও টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চা গাছের সবুজ পাতা তুলতে দেখা গেছে।
চা বাগানগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সূর্যোদয়ের আগেই কনকনে শীতের মধ্যে ৭/১০/১৫ জন গ্রæপে দলবদ্ধ হয়ে বাগানে পাতা তুলছেন। কাঁচি দিয়ে কাটছেন তিন/চার কুড়ি সবুজ পাতা। পাতায় পাতায় হিমেল শিশির থাকলেও একরের একর পাতা তুলে যাচ্ছেন তারা। বড় একটি কাপড়ে বিছিয়ে সেখানে স্তুপ করছেন। দু’তিন জন স্তূপ করা চা পাতা মাথায় করে সড়কের এক পাশে স্তূপ করে রাখছে। পরে বিভিন্ন কারখানা থেকে আসা পিকআপ, তাদের পাতা কিনে পৌছৈ যাচ্ছে কারখানাগুলোতে। শ্রমিকরা প্রতি কেজি চা পাতা তুলে পান ৩ টাকা। সারাদিনে জনপ্রতি ৫০০-৭০০ টাকা, কখনো হাজার টাকা পর্যন্ত হাজিরা উঠে। এ চিত্র তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন চা বাগানের।
কথা হয় চা শ্রমিক নাসির, জামাল, লাল মিয়াসহ বেশ কয়েকজন চা শ্রমিকের সাথে। তারা জানান, তেঁতুলিয়ায় এখন খুব ঠান্ডা। কিন্তু কি করবো, জীবিকার তাগিদে দলবদ্ধ হয়ে ভোরেই পাতা তুলতে লেগে যাই বাগানে। পাতায় পাতায় যেন বরফের অনুভূতি। তবুও সে বরফের শিশির ঝরা পাতা তুলছেন শ্রমিকরা। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদেরও দেখা যায় পাতাল তুলতে। নারী-পুরুষের একই দলেও বাগানে পাতা তুলতে দেখা যায়। সারাদিন কত টাকা মজুরী উঠে জিজ্ঞেস করলে চা শ্রমিক নাসির জানান, আমরা কেজিতে ৩ টাকায় পাতা তুলি। দিনে ৪০০/৫০০ টাকা, অনেক সময় ৭শ থেকে হাজার টাকা মজুরী উঠে।
দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পরের অবস্থান। একসময়ের পতিত গো-চারণ জমি এখন ভরে গেছে চায়ের সবুজ পাতায়। ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে বহু ক্ষুদ্র প্রান্তিক চা চাষীর। দিন মজুর থেকে অনেকেই এখন চা বাগানের মালিক। হয়েছেন বিশাল অর্থ-বিত্তবের মালিক। নিজের জমি না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ভূমি লিজ নিয়ে বাগানের মালিক হয়েছেন অনেক দিন মজুর।
পঞ্চগড়ের ৫ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে চা আবাদ হচ্ছে তেঁতুলিয়ায়। চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে জেলার ২ হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৫ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। তার মধ্যে তেঁতুলিয়ায় ১ হাজার ২শত ৯০ হেক্টরের বেশি জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। বাড়ছে দিন দিন নতুন নতুন বাগান। চা দীর্ঘস্থায়ী অর্থকরী ফসল হিসেবে বছরের ৯ মাস চলে বাগানের বিভিন্ন কাজ। এই কর্মযজ্ঞে বেকার নারী-পুরুষের হয়েছে কর্মসংস্থান। এসব চা বাগানে পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষের কাজের সংস্থান হয়েছে। অর্থনীতিতেও স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন মৌসুম। এ বছর চা পাতার বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। চাষীরা এবার চা পাতা বিক্রয় করে বেশ দামও পেয়েছেন। দাম পাওয়ায় শ্রমিকরাও পেয়েছেন বেশ ভালো মজুরী। গত দু’বছর লোকসানের ঘানি টানলেও এ বছর চা পাতা উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পাতার দাম পাওয়ায় লাভবান হয়েছেন চা চাষীরাও। বর্তমানে জেলায় নিবন্ধিত ৮৯১ জন এবং অনিবন্ধিত ৫০১৮ জন ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছেন। ১৮২ জন স্মল গ্রোয়ার্স যার জমি ৫ একরের নিচে, ৫ থেকে ২০ একরের মধ্যে স্মল হোল্ডার্স ১১ জন এবং ২০ একরের ওপরে ১৯টি টি এস্টেট।
মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন থাকলেও এবার ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগানের সবুজ চা পাতা শ্রমিকরা উত্তোলন করছেন। এটাই শেষ রাউন্ড। শেষ রাউন্ড পাতা তোলার পর শুরু হয় ফ্লাইং কাটিং অর্থাৎ চা গাছের ডালপালা ছাটাই। এরপর শুরু হয় বাগান পরিচর্যা, গাছের মাথা ফ্লাইং কাটিং, পুরুনিং, সার ও কীটনাশক স্প্রে, পানি নিস্কাশনের কাজ। চা শিল্পের বিপ্লব ঘটায় দিনদিন গড়ে উঠছে নতুন নতুন চা বাগান। বাড়ছে শ্রমিকদের ব্যস্ততা। দিনমজুর, পাথর শ্রমিকরা যুক্ত হচ্ছেন চা বাগানের কাজের সাথে।
Posted ১২:৪৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি