| শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯
পা থেকেও নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলতে হয় ১২ বছরের কিশোরী তিসার। জন্মলগ্ন হতেই শারিরীক প্রতিবন্ধী। তবে মেধাবী, বুদ্ধিমতি, কর্মঠ আর অদম্য মনোবল রয়েছে ওর। এবার চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠছে। ক্লাশের সেরা ছাত্রী। পড়ে ফ্রিড মাতৃছায়া অটিস্টিক স্কুলে। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে প্রথম রোল নম্বর তিসার। স্বপ্ন বড় হবার। শারিরীক প্রতিবন্ধকতাসহ সব প্রতিকূলতাকে দূরে ফেলে জীবনে কিছু হবার।
বলছিলাম দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোরী প্রতিবন্ধী ১২ বছরের তিসার গল্প। বাড়ি আজিজনগর গ্রামে। দরিদ্র বাবা-মায়ের কন্যা। অভাব অনটনে চলে দৈন্য সংসার। তার মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়ে বড় হওয়া। বাবা হেলাল মিয়া ওরফে তারা মিয়া। জমি-জমা নেই। বয়স প্রায় সত্তরে পৌছে। কিন্তু পাননি এখনো কোন বয়স্ক ভাতা। দিনমুজুরে চলে সংসার। তারমধ্যে প্রতিবন্ধী কন্যা। টাকার অভাবে শিশু বয়সে অপারেশন করতে পারেননি। ডাক্তার বলেছিলেন, সেসময় অপারেশন করলে কিছু একটা হতো। কিন্তু টাকার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। তাই তিসা সেভাবেই বড় হয়ে ১২ বছরে পা দিয়েছে। প্রতিবন্ধী কার্ডটাও হয়েছে বছর খানিক আগে। তাও অনেক ঘুরাঘুরি করে।
পা না থাকলেও নানান কাজে পারদর্শী তিসা। কয়েক বছর ধরে জাতীয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে অটিস্টিক শিশুদের দলে শারিরীক কসরতে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় তিসাকে। তার এই ডিসপ্লে পারফরমেন্স মুগ্ধ করেছে সর্ব সাধারণ দর্শকসহ বিচারকমন্ডলীদেরও। এবারের বিজয় দিবসে অটিস্টিক তিসার ডিসপ্লে সোস্যাল নেটওয়ার্ক ফেসবুকে পোস্ট হলে সবার দৃষ্টি কাঁড়ে। ওই পোষ্টটি শেয়ার করে কাজী আসাদুজ্জামান লিখেন, শারীরিকভাবে বাঁধার সম্মুখীন হওয়ার পরও বিজয় দিবসে মেয়েটির (তিসা) পারফরমেন্স আমাকে অবিভূত করেছে’।
তিসার বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মা ও ভাই-বোনের সাথে কথা বলে জানা যায়। তিসা শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও বেশ মেধাবী। লেখাপড়ায় খুব মনোযোগ। ক্লাশ ওয়ান হতে রোল নম্বরেও ওয়ান। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংসারিক অনেক কাজ সে পারে। রান্না-বান্না, থালা-বাসন মাজন, কাপড় ধোয়া, দর্জির কাজ আর কৃষি কাজের মধ্যে গরু-ছাগলের ঘাসও সে কেটে এনে খাওয়াতে পারে। কিন্তু সংসারের অভাব তাড়না থাকায় ভাগ্যে জুটে না তেমন সুষম খাবার। ভালো খাবার খেতে চাইলেও মিলেনা কঠিন দারিদ্রতার কারণে।
এ বিষয়ে তিসার মা রেহেনা খাতুন জানান, তিসা জন্মলগ্ন হতেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। শিশু বয়েসে দিনাজপুর নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিল অপারেশন করতে ৭৫ হাজার টাকা লাগবে। টাকার অভাবে অপারেশন করাতে পারিনি। হুইল চেয়ার নাই। ওর চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি। পড়ালেখা করতে চায়, ভালো ভালো খেতে চায়। কিন্তু খুবই অভাব। তাই ওর চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছি না। খুব চিন্তা ওর ভবিষ্যত নিয়ে। এই অবস্থাতেও তিসা পড়ালেখায় অনেক ভালো। খুব ইচ্ছা, ওকে পড়ালেখা করাতে। ভবিষ্যতে ও যেন ভালোভাবে চলতে পারে
এ গ্রামের পরিবেশবাদী ও সাহিত্যিক মাহমুদুল ইসলাম মামুন তিসা সম্পর্কে জানান, তিসা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও বেশ বুদ্ধিমতি। লেখাপড়ায় মেধাবী। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও সে অদম্য সাহস করে সামনে এগিয়ে যেতে চায় জেনে খুব বিস্ময় জাগে। তিসা আমার কাছ থেকে বেশ কয়েকটি ফলের গাছ নিয়ে লাগিয়েছে। গাছগুলো এখন ফল দিবে। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে বই এনে বই পড়ে। ওর পাশে সমাজবিত্তদের দাঁড়ানো উচিত। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ও খুব ভালো করবে।
পা নেই, আক্ষেপ থাকলেও আছে নির্ভয় সাহস। অন্যদের হাটতে দেখে আফসোস হলেও রয়েছে মনে দূর্দান্ত মনোবল তিসার। এ প্রতিবেদককে তিসা জানান, আমি বড় হতে চাই। ভালো কিছু করতে চাই। আর্থিক সহযোগিতা পেলে লেখাপড়া করে স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমার স্বপ্ন, বড় হওয়ার। ভালো কিছু করার।
Posted ১১:০০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি