জিয়াসমিন আক্তার | মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর ২০২০
খুব ভোর বেলায় ঘুম ভাঙলো আমাদের। ১৪ অক্টোবর। বহুদূর থেকে আমরা পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী মানুষ এক দুঃসাহসিক যাত্রার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক ও শারীরিক ভাবে প্রস্তুত! যাত্রাটি খুবই কষ্টকর কিন্তু অসম্ভব নয়! তাই পূর্ণ সাহসের সাথে কেওক্রাডং এর পথে ভোর ছয়টায় আমাদের যাত্রা শুরু করলাম ।
নিতান্ত প্রয়োজনীয় কাপড়, ঔষধ, শুকনো খাবার, মশার কয়েল ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়েই আমরা বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম। কেওক্রাডং এর জন্য তিনটি ব্যাগ কে কমিয়ে একটি ব্যাগ করে আমরা রওনা হলাম, আর বাকি দুটো ব্যাগ আর্মি ক্যাম্পএ জমা রাখলাম।
আমাদের গাইড যাত্রা শুরুর পূর্বে প্রত্যেকের জন্য দশ টাকা দিয়ে একটি করে বাঁশের লাঠি কিনতে বললেন। যদিও এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা কিন্তু তার কথা মতো লাঠি কেনা হলো ও বিসমিল্লাহ বলে শুরুও হলাম।
সত্যি কথা বলতে কি বগালেক এর এলাকা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই খুবই খাড়া রাস্তায় হাঁটা শুরু হয়। আর এক কিলো যেতে না যেতেই এতো ক্লান্ত এতো ক্লান্ত হয়ে পড়ি আমরা যে পা যেনো কিছুতেই চলছে না। এদিকে চারিদিকে শুধু সুন্দর এর মেলা। কোনটা ছেড়ে কোনটার ছবি তুলবো বুঝে উঠতে পারছিনা।
আমাদের গাইড বললেন– ম্যাডাম সামনে আরও অনেক অনেক সুন্দর ভিউ আছে আপনার ফোনের মেমোরি শেষ হবে, চার্জ শেষ হবে কিন্তু ছবি তোলা শেষ হবে না। তাই রোদ চড়া হওয়ার আগেই হেঁটে এগিয়ে যাওয়াই ভালো।
তবু মন কি মানে! টুপ করে ছবি তুলছি, হাঁটছি আর কখনও পিছিয়েও পড়ছি। এক কিলোমিটার পার হওয়ার খানিক পরই গাইড এর নির্দেশনায় পাকা রাস্তা ছেড়ে আমরা ডান পাশের সরু কাঁচা রাস্তা ধরলাম। আর এ পথটা একদমই পাহাড়ি বনের মধ্য দিয়ে। ঘন জঙ্গল ডানে বায়ে সামনে পিছে। বায়ে খাড়া পাহাড়, আমরা সরু রাস্তায় দল ধরে হাঁটছি, আর ডানে জঙ্গলে ঘেরা গভীর খাদ।
আমাদের গাইড সাবধানে পথ চলতে বললেন, কেননা সরু পথের পাশে গভীর খাদ, একটু অসতর্কে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর তারওপর আছে জোঁক এর ভয়। পাহাড়ে প্রচুর জোঁক, যে কোন সময় তারা গায়ে উঠে এসে রক্তের স্বাদ নিতে শুরু করতে পারে।
হাঁটছি আর হাঁটছি, ক্লান্ত হচ্ছি, জিরিয়ে নিচ্ছি, আবার হাঁটছি। আমাদের সাথে দেখা হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে পাহাড়ী আদিবাসীদের সাথে। জানিনা কোন গ্রাম বা পাড়া থেকে তারা পিঠের ওপর বড় বড় বোঝা নিয়ে আসছে। গাইডকে জিগেস করলাম এরা কোথায় যায়? তিনি বললেন- বাজারে ফসল, সবজি, ফল এগুলো বিক্রি করতে।
আমরা অবাক, খালি হাতে হাঁটতে যেখানে আমাদের অবস্থা কেরোসিন, সেখানে অতো বড় বড় বোঝা নিয়ে, কেউ কেউ পিঠে শিশু সন্তানকে বেঁধে কি করে তরতর করে পাহাড় বেয়ে উঠছে, নামছে! পোশাক দেখেই বোঝা যায় তারা খুবই দরিদ্র। এতো কষ্টকর তাদের জীবন, পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই যে কোন কাজে দূরে গমনের!
তখনও পাহাড়ের ঘুম ভাঙেনি ভালো করে। বুনো প্রভাতে ঝিঁঝিঁ ডাকা শব্দ। আর হঠাৎই কানে বাজলো ঝিরি জলের কুলকুল ধ্বনি, যেনো ভৈরবী তান । আমি উচ্ছ্বসিত, নিশ্চিত হতে গাইডকে জিগেশ করলাম কিসের শব্দ? তিনি জানালেন সামনেই লতা ঝর্ণা।
লতা ঝর্ণার জলে পা দিতেই শীতল জলের পরশ আমার সমস্ত শরীরকে যেনো শান্তি এনে দিলো। ঐ মুহূর্তে আমার যেনো কোন ক্লান্তি নেই। ঝর্ণার জলে মুখ, চোখ ভিজিয়ে নিলাম। ঘাড়ে, হাতে পায়ে ভালো করে পরশ দিলাম। খুব শীতল সে জল, একটু উপরে উঠে হাতে নিয়ে জল পান করলাম। আহ্ আর কোন ক্লান্তি নেই, আমরা হাঁটবো, বহুদূর হেঁটে হেঁটে বহুকাল পার হবো!
ঝিরি থেকে বেরিয়ে খুবই খাড়া পাহাড় উঠতে হবে, আস্তে আস্তে সাবধানে উঠলাম লাঠিতে ভর দিয়ে। আর হাড়ে হাড়ে তখন টের পাচ্ছি দশ টাকার বাঁশের লাঠি কি পরিমান উপকারে আসছে।
আর পারছিনা, পা চলেনা, মাথা ঘুরছে রোদও গাছের ফাঁক গলে চড়ে বসছে মাথার ওপর। সেই পথের পাশে পাশে ক্লান্তি মেটাতে স্থানীয় আদিবাসী শিশুরা লেবু, কমলার শরবত নিয়ে বসে আছে। আছে পাহাড়ি পেয়ারা, কমলা, কলা। পথের মধ্যে যখনই ক্লান্ত হয়েছি আমরা দশ মিনিট বসেছি, শরবত কিনে খেয়েছি। খেয়েছি নানা ফল। আশ্চর্য হলো, এতো ক্লান্ত হলেও দশ মিনিট বসলেই আপনি আবার শক্তি ফিরে পাবেন, আর নতুনভাবে হাঁটতে প্রস্তুত হবেন।
পাহাড়ের পর পাহাড়, খাড়া উঁচু নিচু, কোথাও খুব সরু পথ আমরা পেছনে ফেলে হাঁটছি। কতবার ক্লান্তি দুইপা জড়িয়ে ধরেছে। আমরা বসে পরেছি, কিন্তু থামিনি। আমার খুব ভয় ছিলো বাচ্চা দুটোকে নিয়ে, ওরা যদি হাঁটতে না পারে তখন কি করব। ফিরে যেতেওতো হাঁটাই লাগবে, এছাড়া বিকল্প আর কোন পথই নেই।
কিন্তু তাদের দুইজনের উদ্যম দেখে আমি তো অবাক।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকগুলো ছোট বড় ঝিরি পেয়েছি। সবটাতে থামা সম্ভব হয়নি। কিন্তু চিংড়ি ঝিরির কথা বলব এখন। এতো অপূর্ব, এতো সুন্দর চিংড়ি ঝিরি কি বলব আমি। রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে পাথর ধরে উঁচু তে চড়ে আমাদের গাইড এর পিঁছু পিঁছু চিংড়ি ঝর্ণার একদমই কাছে চলে গিয়েছিলাম। আর ওখানে বসেই আমরা সকালের নাস্তা সেরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, কেননা আমরা কিছুই খেয়ে রওনা হইনি, খাবারটা সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়েছি মাত্র।
অপূর্ব চিংড়ি ঝিরি দর্শনেই ভ্রমণ খুবই স্বার্থক মনে হলো,অথচ সামনে আরও কত কি পড়ে, কত পথ কে জানে। ঝর্ণার পরপরই এতো লম্বা একটা খাড়া পথ কি বলব। আর পারছিনা, পা অবশ হয়ে গেছে,ক্রমাগত উঁচুতে উঠার কারনে বুকের ভেতর ধরফর করছে। কি করব, কিভাবে পৌঁছবো কেওক্রাডং!
– গাইড ভাই আর কতদূর, আর তো পারিনা!
– ম্যাডাম আর দুটো পাহাড় পার হলেই দার্জিলিং পাড়া!
ওরে আল্লা আরও দুটো পাহাড়! কি করে হাঁটবো, আমি পারছিনা আর, কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো – থামলে তো হবেনা কিছুতেই, আমাকে পারতেই হবে, যে করেই হোক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতেই হবে, যারা পেরেছে ইতোমধ্যে এই বন্ধুর পথ পেরিয়েছে, তাদের মতো করে আমাকেও পারতে হবে এবং আমি পারব, আমি পারবই……
—– চলবে
Posted ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি