| বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
আব্দুল্লাহ আল মাহাদীঃ
করোনাকাল বিবেচনা করে ক্ষতিগ্রস্থ সকল পেশা-শ্রেণি ও নাগরিকের জন্য সরকার নানা রকম প্রণোদনাসহ সহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়ালেও শিক্ষানবিশ আইনজীবিরা সীমাহীন কষ্ট ও অমানবিকতার শিকার। করোনা পরিস্থিতিতে এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, আইনজীবি, শিক্ষক, এমনকি মসজিদের ইমাম সাহেবরাও সরকারি প্রণোদনা পেয়েছেন। এসব প্রণোদনা পেতে তারা নানারকম মানবিক দাবী ও তদবিরও করেছেন। আইনজীবিরাও এই প্রণোদনা হতে বঞ্ছিত হননি, পেয়েছেন আরো বিভিন্ন ফান্ডের বিভিন্ন সহযোগিতাও, কিন্তু যেসব শিক্ষানবিশ আইনজীবি এসব সিনিয়র আইনজীবিদের সাথে কাজ করে দিন শেষে দু ‘য়েকশ টাকা পেয়ে কোন মতে জীবন যাপন করতেন এই করোণাকালে তাদের বেকার জীবনের দুর্দশা দুর্ভোগ নিয়ে কেউ কথা বলেননি, তারা পাননি কারো কোন নূন্যতম সহযোগিতা।
অবশেষে এসব শিক্ষানবিশ আইনজীবিরা বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন, তবে কোন আর্থিক সহযোগিতা বা খাদ্যের দাবী নিয়ে নয়; বরং তাদের দাবী হলো তাদেরকে পেশাগত কাজের সুযোগ করে দেয়া হোক। এই দাবীতে তারা গত প্রায় ৩ মাস ধরে রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
বর্তমান করোনা কাল বিবেচনা করে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমাণ ১৩ হাজার এমসিকিউ উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশরা দাবী করেন যে তিন ধাপের পরীক্ষার শুধু একটি ধাপ অর্থাৎ রিটেন পরীক্ষা মওকুফ করে ভার্চুয়াল সিস্টেমে ভাইভা নিয়ে তাদেরকে আইনজীবি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হোক। যাতে তারা বর্তমান এই করোনা প্রভাবিত মন্দা সময়ে বৈধ পেশায় কিছু একটা করে জীবন-জীবিকা চালাতে পারেন, বাঁচতে পারেন একটু সম্মানের সাথে। কেননা, আইনজীবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া শেষ করেও অনির্দিষ্টকালের জন্য বেকারত্বের এ অভিশাপের কারণে এসব শিক্ষানবিশদের জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে এসেছে, থমকে গেছে স্বাভাকিব জীবন যাপন। বাড়ির কালো ও অযোগ্য বড় মেয়েটার বিয়ের আগে যেমন তার ছোট বোন একটু সুন্দরি হওয়ায় আগেই বিয়ের পিড়িতে বসে পড়ে, শিক্ষানবিশ বেকার আইনজীবিদের অনেকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই রকম ঘটনা। বড় উকিল হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জীবন-যৌবন সব ধ্বংস করে দিতে হচ্ছে, অনেকে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। এসব প্রতিবন্ধকতা হতে মুক্ত হয়ে স্বপ্নের আইন পেশায় যোগ দেয়ার সুযোগ চান আন্দোলনকারীরা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী বিবেচনায় তাদের এই দাবীকে অনেকেই যৌক্তিক দাবী বলে মনে করলেও কতিপয় সিনিয়র আইনজীবি এই দাবীকে অযৌক্তিক ও হাস্যকর বলে মনে করছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা জায়গায় বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তারা তাদের দাবীর বিপক্ষে শুধু বক্তব্যই দেননি বরং বার কাউন্সিলকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেছেন যাতে আন্দোলনকারীদের দাবী কোনভাবে মেনে নেয়া না হয়।
অথচ যারা শিক্ষানবিশ আইনজীবিদের দাবীর বিপক্ষে তাদেরই সন্তানরা এ বছর স্কুল-কলেজে বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই অটো-প্রমোশন নিতে বেশ আগ্রহী, আনন্দে উদ্বেলিত, গর্বে গর্বিত।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসব অভিভাবকরাও মনে করেন যে, এই করোণাকালে যেহেতু শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারেনি, তাই একমাত্র অটো-প্রোশন ছাড়া কোন বিকল্প নাই। অনলাইন বা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেও পরীক্ষা দিতে তারা নারাজ, কেননা দীর্ঘদিন তারা প্রাইভেট ও কোচিং ক্লাস হতেও বিরত থাকায় পরীক্ষার তেমন কোন প্রস্তুতি নেই তাদের।
কিন্তু এভাবে অটোপ্রোমশন দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রত্যেকেই মনে করেন যে, যেহেতু এটা একটা পেন্ডামিক সিচুয়েশন, অতএব অটো প্রমোশন এখন সময়ের দাবী, শতভাগ যৌক্তিকও বটে। কেননা, যদি এই শিক্ষার্থীদেরকে একই ক্লাসে আরো এক বছর রেখে দেয়া হয়, তাহলেও তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, হতাশা বিরাজ করবে তাদের মনে। মনের ওপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করবে।
অথচ এরকম লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রয়েছেন যারা বর্তমানে এ দেশের সিনিয়র আইনজীবি, অনেকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাথেও সংশ্লিষ্ট। তারা এক্ষেত্রে দ্বিমুখী আচরণ করছেন। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া নিজের সন্তান ও ভাই বোনের ব্যাপারে এই করোনা কালকে মানবিক বিবেচনায় নিলেও বছরের পর বছর বেকার হয়ে সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে ঝুলে থাকা শিক্ষানবিশদের ব্যাপারে এমনটি বিবেচনা করতে তারা নারাজ, অনেকেই হিংসাত্মক মনোভাবও প্রকাশ করছেন। অনেক সিনিয়র আইনজীবি প্রকাশ্যেই এসব শিক্ষানবিশ আইনজীবির দাবীর বিপক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন, অনেকে নানা ভাষায় কটুক্তিও করছেন। যার ফলে শিক্ষানবিশ আইনজীবিরা শুধু হতাশই হচ্ছেন না, বরং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন, লাঞ্ছিত ও অপমাণিত হচ্ছেন। যেটা তাদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলছে। কোন যৌক্তিক দাবীর বিপক্ষে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে কাউকে হেয় করা এবং মানসিক ক্ষতি সাধন করা কতটুকু বৈধ- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে।
এতে করে এক দিকে যেমন সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের সম্মানবোধ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আইন বিষয়ে লেখাপড়ার প্রতি মেধোবীদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে।
বিগত ২০২১৭ ও ২০২০ সনের এমসিকিউ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের যৌক্তিক দাবীর পক্ষে আন্দোলন করে আসলেও সংশ্লিষ্ট বার কাউন্সিল কোনভাবে তা মেনে না নেয়ায় বার কাউন্সিলের নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে বারবার। অথচ এ বিষয়ে কারো কোন টনক নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না, বিষয়টি কেউ খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করছেন না হয়তো। সাংবাদিক থেকে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন বা সচেতন মহলের নীরব আচরণ হতাশ করে তুলছে এসব আন্দোলনকারীদের। নানা রকম রহস্যের গন্ধও পাচ্ছেন তারা।
অনেকেই দাবী করছেন যে, বার কাউন্সিলে কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে যারা এসব পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম করে থাকে, তারাই এখানে কল-কাঠি নাড়ছে, প্রভাব বিস্তার করছে।
শিক্ষানবিশ আইনজীবিরা মনে করেন যে, মাননীয় আইনমন্ত্রী ও বারকাউন্সিলের চেয়ারম্যান সহ সিনিয়র আইনজীবিদের অনেকেই যথেষ্ট মানবিক এবং বিবেকবান হওয়া সত্বেও কতিপয় দুর্নীতিবাজদের এহেন প্রভাবে আন্দোলনকারীদের দাবী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এখানে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট রয়েছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। যার কারণে একই দেশে শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে দুই রকম নিয়ম দেখা যাচ্ছে। করোনার ঝুঁকি এড়াতে এক দিকে স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে তাদেরকে পরীক্ষা ছাড়া অটো প্রমোশন দেয়া ও সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধি করার ঘোষণা, অন্যদিকে দুর্নীতির প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ২৬ সেপ্টেম্বর রিটেন পরীক্ষা নিতে অনড় থাকা কোনভাবেই মেনে নিতে নারাজ ১৩ হাজার শিক্ষার্থী পরিবার।
দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে সারা দেশ হতে ঢাকা শহরে পরীক্ষা দিতে এসে কোন আত্মীয় স্বজনের বাসায়ও জায়গা পাবেননা এসব পরীক্ষার্থীরা। এমন সময়কালে বার কাউন্সিল কর্তৃক রিটেন পরীক্ষা নিতে অনড় থাকার বিষয়টি শুধু অমানবিক নয়, বরং অবৈধ ঘোষণা করার দাবীও উঠেছে।
এই মূহূর্তে শিক্ষানবিশ আইনজীবি ও তাদের অভিভাবকদের দ্বারা এই বিষয়ে আদালতে রীট দায়ের করার পরিকল্পনা চলছে যে, যদি শিক্ষানবিশ আইনজীবিদের যৌক্তিক এ দাবী অবিবেচিত হয় তাহলে স্কুল-কলেজের অটো প্রমোশন সিস্টেমও অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।
তবে ২৬ তারিখে পরীক্ষা বন্ধ করতে কেউ কোন রীট দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেননি এখনো। এ বিষয়ে তারা খুব শিঘ্রি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছেন।
এদিকে ১৩ হাজার শিক্ষার্থীকে ঢাকায় পরীক্ষা নিতে চাওয়া বারকাউন্সিল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এসব বিষয়ে বার বার যে মিটিংগুলো করছেন তা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে করছেন। করোনা ভাইরাসের ছোবল এড়াতে স্বার্থপরের মত নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এরকম সতর্কতা হাস্যকর বলে মনে করছেন সমাজ সচেতনরা।
এই ১৩ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৫০০ শতাধিক শিক্ষানবিশ বর্তমানে করোনাক্রান্ত রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে, তারা হয়তো পরীক্ষা দিতে পারবেনা কিংবা তাদের কেউ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে আসলে শুধু অন্য পরীক্ষার্থীই নয়; বরং সেই হলের পরিদর্শক হতে শুরু করে এই শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। করোনার শুরুতে হঠাৎ গার্মেন্টস খুলে দেয়ায় যারা মিডিয়াগুলোতে সমালোচনার ঝর তুলেছিলেন, এ বিষয়টিও তাদের দৃষ্টিতে আসা উচিত, প্রতিবাদ করা উচিত।
সমস্যাটি কেবল ১৩ হাজার শিক্ষার্থীর নয়, এটা একটা জাতীয় সমস্যায় রুপ নিতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Posted ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি