শহীদুল ইসলাম শহীদ | বুধবার, ২৩ জুন ২০২১
পর্ব-১ ।।
সংবাদ, সংগ্রহ, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা এ চারটি শব্দ শুরু হয়েছে বাঙলা ব্যঞ্জণ বর্ণের ‘স’ বর্ণ দিয়ে। ‘স’ শব্দটি বাংলা অভিধানে সৎ,সত্য, সাধ্য, সাধনা. সহযোগিতা, সহজ, স্বস্তি, সার্থকতা, সমাজ, সংসার, সততা, সাধ এ জাতীয় ভালো কিছু বোঝাতে বেশি ভাগ অংশে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ‘স’ বর্ণটি ঠিক আমার মাথায় কখন প্রবেশ করেছে সেটা ঠিক ঠাওর করতে না পারলেও ‘স’ বর্ণের কাজ গুলোকে লালন করি সেই ছোটবেলা থেকেই। মানুষ হিসেবে সমাজকে কিছু উপহার দেব এমন চিন্তা আমায় সব সময় তাড়া করতো।
তাইতো অভাব অনটনের সংসারে জন্ম হবার পরেও নিজস্ব সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাড়ি দিয়েছি জীবনের অনেক পথ। আমার স্নেহাশীষ অথবা কাছের পরিচিত বন্ধুদের তাই মাঝে মধ্যে বলতাম, ‘জীবনে প্রতিটি অংশে আমার অভাব থাকলেও লোভ নেই।’ হয়তো এ কারণে জেলার বোদা উপজেলার এক গ্রামীণ জনপদে আমার জন্ম হলেও অনেক চড়াই উৎড়াই পথ পাড়ি দিয়ে সমাজের একটি স্তরে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়েছে। আমাদের দুই ছেলেমেয়েকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দেনা-পাওনার হিসেব মেলাতে স্বস্তি ও সার্থকতা দু’টোই পেয়েছি। আমার হাত ধরে পঞ্চগড়ে অনেকের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়েছে। তাদের অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত। সংবাদের ধরণ ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উপস্থাপনের ধাপ ও কার বক্তব্য কোথায় কীভাবে বসবে এগুলোও শিখিয়েছি হাতে কলমে। কখনও বা ধমকও দিয়েছি শেখানোর তাগিদে। তবে তারাই যে এতে উপকারভোগী হয়েছে সেটা নয়,আমারও কাজে লেগেছে সংবাদ সংগ্রহে।
সেই ছোটবেলার অপ্রাপ্তি গুলো এখন ইতিহাসের ডায়েরিতে দোয়াত কালির কলমে লেখা বর্ণ গুলো বিবর্ণ,ঝাপসা,অস্পষ্ট হলেও বলপেনের যুগে আমায় যথেষ্ট সহায়তা করেছে। স্কুল জীবন থেকে এখন পর্যন্ত অনেকেই আমাকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে,করছেন। আমার চলমান লেখায় ‘তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা’ অংশে সেটা শ্রদ্ধাভরে উল্লেখ করব।
স্কুল জীবন ও শিক্ষকতা জীবন নিয়ে সামন্য না বললেই নয়। ব্যক্তি জীবনে আমরা ৫ ভাই, তিনবোন সাথে বাবা মাসহ নিকটজন। কৃষক বাবা কতটুকুই বা তার আয়। সংসারের বিশাল বোঝা বহন করা যেখানে ওষ্ঠাগত সেখানে পড়াশোনা করার চিন্তা বা কল্পনা করা যায়? আমার ব্যক্তিগত চেষ্টা ও ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাধ্যমিক পাশ করি। কলেজ জীবনটা ছিল অনেকটা আকাশ-কুসুম। অবশ্য আমার ছোট ভাইয়ের নামও কাকতালীয় ভাবে আকাশ। সেও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থেকে এখন জার্মানীতে। অনেক কষ্টে সেই সময় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সিইনএড ( সার্টিফিকেট অফ এডুকেশন) কোর্সেও ভর্তি হই।
তৎকালীন এরশাদ সরকার সিইনএড কে এইচএসসি সমমান করার ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে অপর এক ফরমান জারি করে সেটা বাতিল করে। সরকারের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আমরা ছাত্র আন্দোলন করেছি। সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব করার সুযোগও হয়েছে। আমাদের লাগাতার সেই আন্দোলনে সেই ফরমান বদলাতে না পারলেও প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকুরিতে দরখাস্ত করার নিশ্চয়তা পেয়েছিলাম। ভাগ্যচক্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার চাকুরিও জুটে যায়। সংসারের ব্যাগ এবার আমার হাতে। সামান্য বেতন। সেই টাকা দিয়ে এতো বড় পরিবারের ব্যয়ভার সাথে ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ। এর পরও ভেঙ্গে পড়িনি। লক্ষ্যটাকে ঠিক রেখে এগিয়ে গেছি সামনের পথে।
স্কুল জীবন থেকেই টুকটাক লেখালেখি করতাম। পরে সংবাদপত্রে স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করি। বেশ ভালোই কাটছিল দিন। লেখার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড যেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতাম একই সাথে সমাজে ঘটে যাওয়া নানান অসঙ্গতিগুলোও তুলে ধরতাম নির্ধিধায়। পাশাপাশি এক হোমিও দোকানে সহকারির চাকুরির চাকুরিও করেছি। অধ্যাপক ডা. আফিজউদ্দিন আহমদ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সময়ে মাস্টার্স ডিগ্রী পাশ। বেশিরভাগ কথাই হতো ইংলিশে। সে সুবাদে ইংলিশ ভাষাটা আয়ত্ব করার সুযোগও হয়েছে খানিকটা। টিউশনীও করেছি জীবিকার প্রয়োজনে। স্বাধ আর সাধ্যের মধ্যে থেকে সহযোগিতাও করেছি অনেককে। পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর। সেই সময় ওই শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে পাঠাতাম। আত্মীয় স্বজনদেরও সাধ্যমতো খোঁজ খবর নিয়েছি।
সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি শখের বশে আসিনি। আমার মেধা ও মননকে বিভিন্ন অংশে শেয়ার করার মানসে লিখেছি। এখনও লিখি। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সুবাদে জেলার প্রত্যন্ত এলাকার দুর্ভোগ গুলোকে তুলে ধরে সরকারি বেসরকারি উন্নয়নে সহায়তা করার সুযোগও হয়েছে ঠের। সামাজের অসঙ্গতি গুলোও তুলে ধরেছি নির্দিধায়। মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নকে সার্থক করার জন্য সমাজের বিত্তশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছি। সেই লেখার সুবাদে জেলার অনেক অসহায় পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছে, করছে। অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের অনেকে এখনও যোগাযোগ করে, কুশল বিনিময় করে। অনেকের খোঁজই মিলেনা। এজন্য আমার আক্ষেপও নেই।
এ লেখার নেশা কখন যে আমার জীবনে পেশা হবে সেটা শিক্ষকতা করে বুঝতে পারিনি। লেখাটাকে মজবুত করতে সরকারি শিক্ষকতা পেশাকে বাদ দিয়ে আকড়ে ধরার চেষ্টা করেছি। পরিচিতিও পেয়েছি কল্পনাতীত। সাথে পেয়েছি যশ,সম্মান। কিন্তু ওই যে লেখার মাঝপথে বলেছি,‘অভাব আছে, লোভ নেই।’ সেটা এখনও আছে, লালনও করি, সহ্যও করি। তাই তো শত কষ্টের মাঝেও সুখ খুঁজে বেড়াই। আর খুঁজি কোথায় কোথায় ‘স’ বর্ণটিকে কাজে লাগাতে পারিনি। বিশ্ব জোড়া পাঠশালায় এখনও শিখছি, আগামীতেও শেখার মানসিকতাকে লালন করে হালখাতার হিসেব চুকাতে চাইনা। লেখালেখির দীর্ঘ পথচলায় দেনা পাওনার হিসেব না কষলে জীবনের অপূর্ণতা থেকে যায়।
দুপুরের প্রখর রোদ জনজীবনে যতটা দুর্বিসহই হোক না কেন পড়ন্ত বেলার তার লালচে সাজ আমাদের মোহবিষ্ঠ করে,বিগলিত করে। গোধূলী বেলার সেই ক্ষণে দড়ি ছাড়াই ধেনু যেমন ফিরে যায় তার আপন ঘরে। গেরস্ত বাড়িতে সবকিছু গোছানোর পালা পড়ে যায়। কিশোর কিশোরীরা মনের আনন্দে সূর্য়ের লালচে আবহে নিজেদের মেলে ধরে। নববধূ প্রতিক্ষার প্রহর গুনে কাজ শেষে এই ফিরে আসছে প্রাণের সখা। দিন-রাতের মিলন মুহূর্তের এমন একটি আবহে আমার এ পথ চলায় দেনা পাওনার হিসেব যদিও মিলানো কষ্টের; তারপরও করতে হয়। হিসেবের লাভ-লোকসানে নয়, ব্যক্তি হিসেবে কী করেছি আর কী করা প্রয়োজন সেটা খুঁজে পেলেই আমার পূর্ণতা।
ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল পাকির জয়নাল আবেদীন মুহম্মদ আব্দুল কালাম তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমের ঘোরে দেখে; বরং স্বপ্ন সেটাই যেটা মানুষকে ঘুমোতে দেয়না।’ আমিও এমনই স্বপ্ন দেখি। আসলে আমারও কিছু করার আছে, আছে সমাজ, সংসার, দেশ-জাতির জন্য আমার দায়বোধ। আর এ দায় বোধ থেকে দেনা-পাওনার হালখাতা না করেই নতুন উদ্যোমে পথচলা। আগামী লেখায় আমার ব্যক্তি জীবনের খন্ডচিত্র গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দৈনিক দেশ রূপান্তর ও বাসস
Posted ১২:৪৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৩ জুন ২০২১
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি