জিয়াসমিন আক্তার | বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০
“আমায় ডাক দিলো রে
হাত বাড়ায়ে মন নাড়ায়ে
কোন সে ভোরে, নিঝুম রাত্রি ঘোরে
কোন মেঘটা আড়াল হলো নিমন্ত্রণে
তার খোঁজে আজ তেপান্তরে,
পথের মাঝে পথ হারায়ে
মন ছুটেছে, প্রেম জমেছে
কপাল জুড়ে বিন্দু নেশার জলে
তবু উজাড় হয়েই যাচ্ছি ভেসে
অচিন দেশে অচিন মেঘের খোঁজে
ডাকলো আমায় সে মেঘ এসে
মেঘের সাগর দেশে!”
কোন কষ্ট আমাদের আটকাতে পারেনি, আমরা ঠিকই পথ কেটে পথ করেছি গন্তব্যে! অবশেষে কেওক্রাডং এর পাদদেশে আরেকটি পাহাড়ের উপর বাংলাদেশের সবথেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দার্জিলিং পাড়ায় আমরা পৌঁছলাম। আর দূর থেকে প্রথম দর্শন পেলাম আমাদের লক্ষ্য, কেওক্রাডং পাহাড়ের!
ওই মুহূর্তে বিশ্বাস করেন কোন ক্লান্তিই অনুভূত হয়নি। আমরা তখন নিশ্চিত আমরা কেওক্রাডং এ পৌঁছতে পারবো, এইত আর আধঘন্টার পথ!
আমাদের গাইড দুপুরের গোসল, লাঞ্চ এই দার্জিলিং পাড়া থেকেই সেরে নেয়ার জন্য পরামর্শ দিলো। কেননা কেওক্রাডং এ জলের খুব অভাব। সেখানে এক বালতি গোসল এর পানি ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয় আর খাবারের মানও খুব ভালো না।
তখন আমরা খুবই ক্ষুদার্ত এবং ঘামে, কাঁদায় মাখামাখি শরীরটাকে পরিষ্কার করাও জরুরি মনে করছি। তাই আমরা দার্জিলিং পাড়ার একটা হোটেলে ঢুকে সবার গোসল সেরে ফেললাম তারপর দুপুরের লাঞ্চ।
একটা বিশেষ খাবার এর কথা না বললেই নয়, যা কেওক্রাডং পাহাড় ভ্রমণ কে আরও স্মরণীয় করেছে তা হলো-
বেম্বো চিকেন ( পাহাড়ি মুরগী)
বাঁশের ক্রোল ভুনা
আদা ফুলের চাটনি
জুম চাষে প্রাপ্ত ধানের গরম ভাত
অসাধারণ, অসাধারণ টেস্ট পেতে হলে অবশ্যই কেউ ওদিকটায় গেলে চেখে দেখবেন। আমরা অভিভূত। সত্যি কথা বলতে কি বগালেক কেওক্রাডং ভ্রমণ এর সব বেলায়,সব জায়গায় খাবারের ভেতর এই দার্জিলিং পাড়ার ” কিং বয় রেস্টুরেন্ট” এর বেম্বো চিকেন, ক্রোল ভুনা, আদা ফুলের চাটনি ও জুম চালের গরম ভাত সব থেকে মজাদার স্পেশাল খাবার! এছাড়াও ওখানে আপনি গরম কফি পাবেন।
খাওয়ার পর কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর একটু দূরে কেওক্রাডং পাহাড় দেখছি, কেমন যেনো এক নেশাময় অনুভব বলে বোঝাতে পারব না। দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওক্রাডং এর দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।
বেলা তিনটা পর্যন্ত দার্জিলিং পাড়া খাওয়া বিশ্রাম এর পর আমরা আমাদের শেষ গন্তব্য বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং এ উঠার জন্য রওনা হলাম। এরই মধ্যে ওখানে যে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছে তা আমরা দার্জেলিং পাড়া থেকে দেখতে পেরেছি। জানিনা পথ কতটা পিচ্ছিল হবে। কিন্তু আমাদের গাইড আস্বস্ত করলেন যাত্রাপথ ভালোই হবে।
আমরা রওনা হলাম। তখন মেঘভাঙা রোদে প্রচন্ড তাপ। আর দূরে বৃষ্টি পরের রংধনু! আহ্ সে কি দৃশ্য! মনের মধ্যে বিজয়ের গুঞ্জন। কিন্তু পথ তো আর ফুরায় না। হাঁটছি আর হাঁটছি। কখনও খুব খাড়া,বৃষ্টির জল জমে গর্ত, খানিক পিচ্ছিলও। গড়িয়ে পড়লেই কম্ম সারা।
– ও গাইড ভাই আর কতদূর? যা খেয়েছি সবইতো শেষ হয়ে গেলো।
তিনি হাসে আর বলে-
– এইত এসে পড়েছি, এইত আর খানিক পথ বাকি।
প্রায় এক ঘন্টা পাহাড় চড়ার পর আমরা পৌঁছলাম কেওক্রাডং এর চুড়ায়। তখন পনে পাঁচটা হবে। আর্মি ক্যাম্পএ নাম এন্ট্রি করে গাইড প্রথমে আমাদের বুক করা কটেজে নিয়ে গেলো। হাঁটবো, নাকি দেখবো! কোন দিকে দেখবো, কোনদিকে দেখবো না বুঝতে পারছি না।
মুহূর্তে সব ভুলে গেছি, এই এখানে এখন বিকাল পাঁচটা। আর আমরা ভোর ছয়টায় রওনা দিয়েছি, এতো এতোগুলা পাহাড় ডিঙিয়েছি, এতো কষ্ট, এতো ক্লান্তি, পা ব্যথা সব ভুলে গেছি, সব সব ভুলে গেছি সেই মুহূর্তে আমরা। এতো সুন্দর, এতোটাই সুন্দর মেঘের সেই পশরা, মেঘের উৎসব কি বলব আমি।
“কোন মেঘটার নিমন্ত্রণে আজ এসেছি
সব মেঘেদের মেলার ফাঁকে ভুলেই গেছি
সেই চিঠিটা বুক পকেটে
কি লিখেছে আজও আমার হয়নি পড়া
শুধু জানি
অচিন মেঘের নিমন্ত্রণে আজ এসেছি
সেই খুশিতে সকল মেঘ আজ আত্মহারা! ”
অনেকক্ষণ বসেছিলাম কেওক্রাডং এর চুড়ায়। কোথায় গেলো সেই তাপ জানিনা, সেখানে তখন বাতাস, হিমেল পরশ। সব মেঘেদের উপরে আমরা। দূর দূরান্ত থেকে মেঘেরা ছুটে আসছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে চোখে মুখে চুলে। বিন্দু বিন্দু মেঘ জমেছে, তখনই টের পেলাম যখন দেখলাম আমার খোলা চুল ভেজা।
দূরে দূরে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আর পাদদেশে ছোট্ট ছোট্ট পাড়া। সকালে যাদের সাথে দেখা হয়েছিল, তারা বুঝি ওইসব পাড়াতেই থাকে। কিন্তু ওখানে যাওয়া নিষেধ, বড় বড় হরফে সাইনবোর্ড টাঙানো, পড়ে বুঝলাম।
হেলিপ্যাড এ গেলাম, ছবি কত তুলব। প্রতি মুহূর্ত আকাশের রঙ বদলাচ্ছে। হুট করেই চারপাশটা মেঘে ঢেকে গেলো, খানিক দূরের মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। তাই সূর্যাস্তটা দেখা হলোনা আমাদের। আমরা কটেজে ফিরে এলাম। কটেজের বারান্দায় বসে মেঘ শুঁকছিলাম, মেঘ মাখছিলাম গায়ে।
রাতে খুব শীত। খাবারের মান খুব ভালো নয়। কোনরকম খাওয়া সেরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। খুব ঘুম জরুরি, ভোরে উঠতে হবে এবং সাতটার মধ্যেই রওনা হতে হবে সেই বগালেক এর উদ্দেশ্যে।
কিন্তু ঘুম কোথায়? বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলেও আমার চোখে ঘুম নেই। কোথায় এসেছি, মেঘের মেলায় ভেসে আছি। জানলা, দরজার ফাঁক দিয়ে তখন মেঘ ঢুকছে ঘরে।
আজ নিশি শুধু মেঘের গল্প শুনব
মেঘমালা নিলাম তুলে গলে!
——— চলবে
Posted ২:৩২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০
দৈনিক প্রথম দৃষ্টি | প্রথম দৃষ্টি